শিরোনাম দেখে সম্মাণিত পাঠকবৃন্দের মাঝে এ ধারণা সৃষ্টি হবে যে, এখানে লেখক বীজ সম্পর্কিত বিষয়ের উপর আলোকপাত করতে চাচ্ছেন। সত্যি তাই, “বীজ হলো কৃষির প্রাণ”। চিরন্তন শুনে আসছি,‘ সুবীজে সুফসল’, ‘সুবংশে সুসন্তান’। বাংলাদেশের কৃষি ক্ষেত্রে বলা হয়ে থাকে, অন্যান্য উপকরণ ঠিক রেখে শুধুমাত্র উন্নতমানের ভালো বীজ ব্যবহারে ২০-২৫ % ফলন বৃদ্ধি পায়। তাহলে একটি প্রশ্ন, ভালো বীজই কি মান সম্মত বীজ ? হ্যাঁ, এখানে ভালো বীজকে মান সম্মত বীজ বলা হয়েছে। বীজের উদ্ভিদতাত্ত্বিক ও কৃষিতাত্ত্বিক সংজ্ঞা রয়েছে। কৃষিতাত্ত্বিক দিক হতে উদ্ভিদ বা শস্যের যে কোন অংশ যা তার বংশবৃদ্ধিতে সক্ষম সেটিকে বলা হয় বীজ। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় ঃ আখের কান্ড, পাথরকুচির পাতা, লেবুর কান্ড, মিষ্টি আলুর লতা বা মূল ইত্যাদি। ফসল উৎপাদনের কথা মুখে আনলে যে উপকরণটির একান্ত প্রয়োজন হয়ে পড়ে-তার নাম হলো বীজ। এজন্য বলা হয়,“বীজ হচ্ছে ফসলের প্রাণ”। তাই ভাল ফসল পেতে হলে ভাল বীজ প্রয়োজন। কৃষিজ উৎপাদনে যে কয়টি উপকরণ ব্যবহার হয় তার মধ্যে বীজ ব্যাতিক্রম ধর্মী উপকরণ। সার, কীটনাশক, বালাইনাশক, পাওয়ার টিলার, স্প্রে মেশিন, কমবাইন্ড হারভেস্টারসহ যাবতীয় যন্ত্রপাতি কারখানায় প্রস্তুত করা হয় অর্থাৎ এগুলো ইন্ডাষ্ট্রিয়াল প্রোডাক্ট। কিন্তু বীজ ইন্ডাস্ট্রিয়াল প্রোডাক্ট নয়। বীজ কৃষকের দ্বারা মাঠেই উৎপাদন করে নিতে হয়। বিগত এক দশক যাবত লক্ষ্য করা যাচ্ছে যে, বাংলার কৃষক ‘হাইব্রিড’ নামক বীজের জন্য জান পরাণ। চাই সে যে কোন ফসলের বীজ হোক না কেন। কারণ, কৃষকের মনে এ ধারণা বিদ্ধ হয়েছে যে, হাইব্রিড বীজ ব্যবহার করলে উৎপাদন বাড়ে। কৃষকের এই ‘পজিটিভ এ্যাটিচিউড’ কে কাজে লাগিয়ে ফটকা কারবারি, অসাধু বীজ ব্যবসায়ী অনুন্নত বীজকে হাইব্রিড বীজের মোড়কে ঢুকিয়ে হাতিয়ে নিচ্ছে লক্ষ-কোটি টাকা, সর্বশান্ত হচ্ছে হাইব্রিড প্রেমী হাজার হাজার কৃষক।এ অবস্থা থেকে উত্তরণের উপায় হচ্ছে,“বৃহৎ পরিসরে মান সম্মত বীজ উৎপাদনকারি চাষীর সংখ্যা বৃদ্ধি করা”। বিভিন্ন বীজের মোট চাহিদার শতকরা মাত্র ৮-১০ ভাগ উন্নতমানের বীজ বিভিন্ন বীজ উৎপাদনকারী বেসরকারি সংস্থা, কোম্পানী এবং ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে সরবরাহ করা সম্ভব হচ্ছে। সরকারি সংস্থা হিসাবে বিএডিসির সক্ষমতা শতকরা ৫-৬ ভাগ থেকে ১০-১২ ভাগে উন্নীত হয়েছে। এটা অনেকটা হতাশার মাঝে আশার আলো। অবশিষ্ট শতকরা প্রায় ৮০ ভাগ বীজের চাহিদা কৃষকের নিজস্ব সনাতনী পদ্ধতিতে সংগ্রহ ও সংরক্ষণের মাধ্যমে মেটানো হচ্ছে যার গুনগত মান নিশ্চিত নয়। যেহেতু শতকরা ৮০ ভাগ বীজের চাহিদা কৃষকের উপর নির্ভরশীল, তাই মান সম্পন্ন বীজ উৎপাদনের ব্যাপারে কৃষি সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে আরো ব্যাপক তৎপরতা চালাতে হবে। মান সম্পন্ন বীজ উৎপাদনের ক্ষেত্রে অনেকগুলো ফ্যাক্টরের মধ্যে আইসোলেশান একটি গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর। তা হলে আসা যাক, ‘আইসোলেশান’ সম্পর্কে কিছু জানার।
আইসোলেশান ঃ বীজের জন্য উৎপাদিত ফসলকে একই ফসলের অন্য জাত থেকে ন্যূনতম দূরত্বে ভিন্ন মাঠে/একই মাঠে আবাদ করার প্রক্রিয়াকে বলা হয় আইসোলেশান বা পৃথকীকরণ পদ্ধতি। এই আইসোলেশান পদ্ধতি বা দূরত্ব বিভিন্ন ফসলের বেলায় ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে।
আইসোলেশানের প্রয়োজনীয়তা ঃ (১) জাতের বিশুদ্ধতা রক্ষার্থে অনাকাংখিত পরাগরেণুর মাধ্যমে পর-পরাগায়ন এবং মুক্ত পর-পরাগায়ন ফসলের পরাগায়ন প্রক্রিয়াতে বাধা সৃষ্টি করা।(২) স্ব-পরাগায়িত জাতসমূহে পর-পরাগায়ন প্রক্রিয়া সৃষ্টির সুযোগ এবং যান্ত্রিক মিশ্রনকে (গবপযধহরপধষ গরীঃঁৎব) নিয়ন্ত্রণ করা।(৩) পরাগায়ন দূষণ (চড়ষষবহ ঈড়হঃধসরহধঃরড়হ) প্রক্রিয়া বন্ধ করা। সর্বপরি বলা যায়, আইসোলেশান প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মান সম্পন্ন বীজ উৎপাদন নিশ্চিত করা। নি¤েœ বীজ উৎপাদনের লক্ষ্যে বিভিন্ন ফসলের ন্যূনতম আইসোলেশান (নোটিঢাইড ফসল) দূরত্ব বর্ণিত হলো ঃ
তালিকায় প্রজনন বীজের দূরত্ব উল্লেখ করা হয়নি। কারণ, প্রজনন বীজ বিশেষ প্রক্রিয়ায় বিশেষজ্ঞ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত অবস্থায় উৎপাদন করা হয়।
বীজ উৎপাদনের লক্ষ্যে নন-নোটিঢাইড ফসলের ন্যূনতম আইসোলেশান দূরত্ব বর্ণিত হলো ঃ
এখানে উল্লেখ্য যে, আইসোলেশানের ন্যূনতম দূরত্ব ভিত্তি বীজের ক্ষেত্রে প্রত্যায়িত বীজ অপেক্ষা অনেক অনেক বেশি। আবার স্ব-পরাগায়িত বীজের আইসোলেশান দূরত্ব পর-পরাগায়িত/মুক্ত পর-পরাগায়িত বীজের তুলনায় অতি সামান্য।
আইসোলেশান নিয়ে কৃষক পর্যায়ে বিরাজিত সমস্যা ও করণীয় ঃ
বর্তমানে বিএডিসি, কৃষি সম্পসারণ অধিদপ্তর, এনজিও এবং বীজ ব্যবসায়ীদের বহুবিধ বীজ উৎপাদনমূলক কর্মকান্ড দৃশ্যমান। আইসোলেশানের দূরত্ব বজায় রেখে মাঠ পর্যায়ে কৃষক বীজ উৎপাদনের বেলায় জমি ছাড় দিতে রাজী হয় না। আইসোলেশান গ্যাপে কোন বেরিয়ার ফসল উৎপাদনে হয় নিরৎসাহিত। কাজেই আইসোলেশান বিষয়ের উপর কৃষক প্রশিক্ষণে সবিশেষ গুরুত্ব প্রদান করতে হবে। প্রয়োজনে কৃষককে ঐ সমপরিমাণ জমির জন্য ভূর্তকি প্রদানের ব্যবস্থা করতে হবে। বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সীর জনবল বৃদ্ধি করতঃ তদারকি কার্যক্রম জোরদার করতে হবে। অসাধু বীজ ব্যবসায়ীদের অপতৎপরতারোধে বীজ আইন ১৯৯৮ ও ২০১৬ কে কার্যকর করতে হবে।
ড.মুহাম্মদ মহী উদ্দীন চৌধুরী
প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, সরেজমিন গবেষণা বিভাগ, বিএআরআই, নোয়াখালী, মোবাইল ঃ ০১৮২৭-৮৬৫৮৬০, ই-মেইল- ঢ়ংড়ড়ভৎফনধৎর@মসধরষ.পড়স